সামগ্রিক উন্নয়ন বলতে একটি দেশের অবকাঠামোগত ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে মানব সম্পদের উন্নয়নকেও বুঝায়। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক নারী। এই অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে উন্নয়ন কার্যক্রমের মূলস্রোতে অন্তর্ভুক্ত না করে বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তাই নারীর অংশগ্রহণ অপরিহার্য। এই অংশগ্রহণ সুবিধাভোগী হিসেবে নয়, হতে হবে অংশীদারিত্বমূলক। অবকাঠামোগত ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ অংশীদারিত্বমূলক করতে পারলে অর্জিত সামগ্রিক উন্নয়ন হবে সুসংহত।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের যাবতীয় উন্নয়ন কর্মকান্ড মূলতঃ পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন, ক্ষুদ্রাকার পানি সম্পদ উন্নয়ন এবং নগর অবকাঠামো উন্নয়ন এই তিনটি প্রধান সেক্টরকে ঘিরেই পরিচালিত হয়। এ সকল কার্যক্রমের সকল স্তরে জেন্ডার সমতা অর্জনের লক্ষ্যে নারীদের অধিক হারে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং স্ব-স্ব ক্ষেত্রে সামর্থ্য বৃদ্ধির জন্য সরকারের প্রণীত ২০১১ সালের জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালার ধারাবাহিকতায় সময়োপযোগী করে ইতিমধ্যে এলজিইডি’র একটি জেন্ডার সমতাকরণ কৌশল প্রণীত হয়েছে এবং উক্ত কৌশলের নয়টি ক্ষেত্রকে অনুসরণ করে সেক্টরভিত্তিক কর্মপরিকল্পনাও প্রণয়ন করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, প্রণীত কৌশলের ক্ষেত্রসমূহের উপর ভিত্তি করে জেন্ডার মনিটরিং ফরমেট প্রণয়ন করা হয়েছে। নতুন ডিপিপি এবং ট্রেনিং কোর্স ম্যাটেরিয়াল প্রণয়নের ক্ষেত্রে জেন্ডার সংক্রান্ত বিষয়ে যথাসম্ভব সমন্বিত করার লক্ষ্যে জেন্ডার এন্ড ডেভেলপমেন্ট ফোরাম কর্তৃক নিরীক্ষণ করার ব্যাপারে ইতিমধ্যে প্রধান প্রকৌশলীর স্বাক্ষরে পত্র জারী করা হয়েছে।
জেন্ডার এন্ড ডেভেলপমেন্ট ফোরাম ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে নিয়মিত সভায় মিলিত হয়। এ সভায় গ্রামীণ, নগর ও ক্ষুদ্র পানি সম্পদ অবকাঠামো উন্নয়নে এলজিইডি’র প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা বহুমূখী উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে পুরুষের পাশাপাশি নারীর কাজের সুযোগ সৃষ্টি, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ, আত্ম-কর্মসংস্থানের মাধ্যমে তাঁদের স্বাবলম্বী করা ও নারীর ক্ষমতায়নসহ এলজিইডি’তে জেন্ডার সমতা প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের বিষয়গুলো আলোচনা করা হয়ে থাকে। এ ফোরামের সদস্য সংখ্যা ২৫ (পঁচিশ) জন। ফোরামের সভাপতি-অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (বাস্তবায়ন), সহসভাপতি-তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (প্রশিক্ষণ ও মাননিয়ন্ত্রণ) এবং সদস্য-সচিব, উপ-প্রকল্প পরিচালক, কোষ্টাল ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট ইনফ্রাষ্ট্রাকচার প্রকল্প।
জেন্ডার এন্ড ডেভেলপমেন্ট ফোরামের তত্ত্বাবধানে এলজিইডি’তে ডে-কেয়ার সেন্টার পরিচালিত হয়। এই ডে-কেয়ার সেন্টার পরিচালনার উদ্দেশ্য-এলজিইডি’তে কর্মরত কর্মকর্তা/কর্মচারীদের ০৬ মাস থেকে ০৫ (পাঁচ) বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের অফিসকালীন সময়ে নিরাপদে রাখা, ছোট্ট শিশু সন্তানদের কাছাকাছি রেখে কোন মানসিক চাপ ছাড়াই কর্মকর্তা/কর্মচারীদেরকে সুষ্ঠুভাবে দাপ্তরিক কাজ করার সুযোগ রাখা, ছোট্ট শিশুদের মাতৃ সাহচর্যের সুযোগ সৃষ্টি করে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সহায়তা করা এবং সর্বোপরি, আয়মূলক কাজে অংশগ্রহণে নারীদেরকে উৎসাহিত করা।
এই ডে-কেয়ার সেন্টারে শিশুদেরকে সার্বক্ষণিক দেখাশুনা করার জন্য ০১ (এক) জন সুপারভাইজার, ০২ (দুই) জন সহকারী সুপারভাইজার এবং ০৫ (পাঁচ) জন কেয়ার গিভার রয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (প্রশাসন) এর সভাপতিত্বে ডে-কেয়ার সেন্টার পরিচালনা কমিটি ০৩ (তিন) মাস অন্তর ডে-কেয়ারের কার্যক্রম পর্যালোচনা করেন। এ ছাড়া ডে-কেয়ার সেন্টারের বিভিন্ন রকম সুবিধা-অসুবিধার বিষয়ে শিশু সন্তানদের অভিভাবকগণকে নিয়ে জেন্ডার এন্ড ডেভেলপমেন্ট ফোরামের সদস্য-সচিব আলোচনা সভা করে থাকেন এবং পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার পরিচালনা কমিটিকে অবহিত করেন।
জেন্ডার এন্ড ডেভেলপমেন্ট ফোরাম একটি সুনির্দিষ্ট বাৎসরিক (জুলাই-জুন) কর্মপরিকল্পনাকে অনুসরণ করে জেন্ডারকে মূলধারায় নিয়ে আসার বিষয়ে এলজিইডি’র ব্যবস্থাপনাকে সহযোগিতা করে থাকে। উক্ত কর্মপরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মক্ষেত্র হলো এলজিইডি’র জেন্ডার কার্যক্রম ডকুমেন্টেশন। উক্ত কার্যক্রমের ওপর প্রকাশিত ‘জেন্ডার উন্নয়নে এলজিইডি’ প্রথম প্রতিবেদন ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। জেন্ডার সংক্রান্ত বিভিন্ন কার্যক্রমের অগ্রগতি এবং এলজিইডিতে জেন্ডার কার্যক্রমের ধারাবাহিক উত্তোরণের বিষয়ে এই প্রতিবেদনে বর্ণনা করা হয়েছে। জেন্ডার বিষয়ে আরও সচেতনতা বাড়াতে প্রতিবেদনটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। প্রতিবেদনটি এলজিইডি’র সদর দপ্তর পর্যায়ে ও মাঠ পর্যায়ের সকল দপ্তরে প্রেরণ করা হয়েছে।
কর্মপরিকল্পনার আরো একটি কর্মক্ষেত্র হলো এলজিইডি’র সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালক, প্রকল্পের জেন্ডার ফোকাল পয়েন্ট এবং জেন্ডার বিশেষজ্ঞদের নিয়ে জেন্ডার সংক্রান্ত বিষয়ে মত বিনিময়ের জন্য কর্মশালার আয়োজন। কর্মশালাটি সাসটেইনেবল রুরাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইমপ্রুভমেন্ট প্রকল্পের সহযোগিতায় সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
জেন্ডার এন্ড ডেভেলপমেন্ট ফোরামের বাৎসরিক কর্মপরিকল্পনার অন্যতম আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মক্ষেত্র হলো আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন। ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক নারী দিবস’২০১৬ এর প্রতিপাদ্য ঠিক করেছে-‘অধিকার, মর্যাদায় নারী-পুরুষ সমানে সমান’। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ প্রতিপাদ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সময়োপযোগী। প্রতি বছরের মত এ বছরেও এলজিইডি জেলা পর্যায়ে বর্ণাঢ্য র্যালী করে আন্তর্জাতিক নারী দিবস’২০১৬ উদযাপন করেছে।
প্রধান প্রকৌশলী মহোদয়ের দিক নির্দেশনায় সদর দপ্তর পর্যায়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবস’২০১৬ উদযাপন করা হয়েছে ৮ মার্চ ২০১৬’তে। এ দিনে এলজিইডি’র অধীন বিভিন্ন প্রকল্প বা কর্মসূচি হতে সুফল ভোগ করে যে সকল দুঃস্থ নারী আত্মনির্ভরশীল হচ্ছেন তাঁদেরকে উৎসাহ ও উদ্দীপনা প্রদান এবং অন্যদের মাঝে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার সচেতনতা সৃষ্টি করার লক্ষ্যে শ্রেষ্ঠ আত্মনির্ভরশীল নারী সম্মাননা পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
এলজিইডি’র তিনটি সেক্টর যথাঃ পল্লী উন্নয়ন, পানি সম্পদ উন্নয়ন এবং নগর উন্নয়ন সেক্টরের বিভিন্ন কার্যক্রমে সম্পৃক্ত নারীদের মধ্য থেকে প্রাপ্ত আত্মনির্ভরশীল নারীর তথ্যাদির আলোকে প্রতি সেক্টর থেকে ০৩ (তিন) জন করে মোট ০৯ (নয়) জন সফল নারীকে নির্বাচিত করা হয়েছে। মানবিক ও পেশাগত সক্ষমতা, আর্থিক সক্ষমতা, সম্পদের মালিকানা, সামাজিক সফলতা ও ক্ষমতায়ন এই পাঁচটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে আত্মনির্ভরশীল নারীদের শ্রেষ্ঠত্ব মূল্যায়ন করা হয়েছে সেক্টর ভিত্তিক তিনটি মূল্যায়ন কমিটির মাধ্যমে। শ্রেষ্ঠ আত্মনির্ভরশীল নারী নির্বাচনের পাশাপাশি এলজিইডি’র প্রকল্পসমূহের জেন্ডার সংক্রান্ত কার্যক্রমকে ফটোগ্যালারীর মাধ্যমে তুলে ধরে তার মধ্য থেকে তিনটি প্রকল্পকে সফল হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে একটি বিশেষ মূল্যায়ন কমিটির মাধ্যমে। জেন্ডার কার্যক্রমে সফল এমন তিনটি নির্বাচিত প্রকল্পগুলো যথাক্রমে: (১) হাওর অঞ্চলের অবকাঠামো ও জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্প (২) অংশগ্রহণমূলক ক্ষুদ্রাকার পানি সম্পদ সেক্টর প্রকল্প (৩) নর্দান বাংলাদেশ ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট। নির্বাচিত তিনটি প্রকল্পকে সম্মাননা হিসেবে ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। নিম্নের ছকে বর্ণিত ০৯ (নয়) জন আত্মনির্ভরশীল নারীদের সম্মাননা হিসেবে ১০,০০০/=(দশ হাজার) টাকাসহ সার্টিফিকেট ও ক্রেস্ট প্রদান করা হয়-
এ ছাড়াও কর্মপরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মক্ষেত্র হলো ফোরামের কর্মকর্তাবৃন্দ কর্তৃক এলজিইডি’র মাঠ পর্যায়ের বিভিন্ন সেক্টরের কার্যক্রম পরিদর্শন। পরিদর্শনের লক্ষ্যণীয় বিষয়গুলি হলো-
কাজের উপযুক্ত পরিবেশ অর্থাৎ তা জেন্ডার সংবেদনশীল কিনা (বসার সুব্যবস্থা, পৃথক টয়লেট, নির্মান সাইটে নারীদের জন্য পৃথক লেবার শেড ইত্যাদি উপযুক্ত কিনা)। ভৌত অবকাঠামো নির্মান এবং অন্যান্য কাজে নিয়োজিত নারী শ্রমিকগণকে মজুরী সঠিক সময়ে এবং সম-পরিমান কাজের জন্য সম-মজুরী পরিশোধ করা হয় কিনা। শ্রমিক হিসেবে নারী ও পুরুষের সংখ্যা আলাদাভাবে নিরূপিত হয় কিনা এবং মহিলা বিপনী সেকশন ‘মহিলা’ কর্তৃক পরিচালিত হয় কিনা। জেলা পর্যায়ে ‘জেন্ডার কমিটি’ গঠন এবং কমিটির সভা নিয়মিত অর্থাৎ ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে হয় কিনা। জেলা জেন্ডার ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের বিষয়াদি পর্যবেক্ষণ করা এবং জেলার মাসিক সভায় ‘জেন্ডার বিষয়’ এজেন্ডাভুক্ত হয় কিনা। প্রতি ছয় মাস অন্তর জেলা থেকে পল্লী উন্নয়ন সেক্টর এবং ক্ষুদ্রাকার পানি সম্পদ উন্নয়ন সেক্টরের ‘জেন্ডার মনিটরিং ফরমেটের আলোকে প্রতিবেদন’ সদর দপ্তরে প্রেরণ করা হয় কিনা। উপরোক্ত লক্ষ্যণীয় বিষয়গুলিকে বিবেচনায় রেখে ইতিপূর্বে কিছু জেলা পরিদর্শন করা হলেও এ কার্যক্রমে আরো গতি আনা প্রয়োজন। এজন্য এলজিইডি’র জেন্ডার সংক্রান্ত কার্যক্রম গতিশীল করার লক্ষ্যে ৬৪টি জেলায় যখন এলজিইডি’র ভৌত কার্যক্রম ফলোআপ করা হবে, ঠিক তখনই একই সাথে জেন্ডার সংক্রান্ত কার্যক্রম ফলোআপ করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে পরিদর্শন টিমের সম্মানিত আহবায়কগণকে কার্যক্রম গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা যেতে পারে।